আইভিএফ বা টেস্টটিউব শিশু সম্পর্কে আপনার যা কিছু জানা প্রয়োজন (all about In vitro fertilization[IVF] in brief)

বন্ধ্যাত্ব প্রতিকারে নৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে আইভিএফ বা টেস্টটিউব শিশুঃ

আসসালামুয়ালাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু,
বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টিলিটি  আজকাল বহুল আলোচিত সমস্যাগুলোর একটি। দিনকে দিন এই সমস্যা ক্রমন্বয়ে প্রকট আকার ধারন করছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা একটা সমাধান যোগ্য সমস্যা। কেননা জীবন যাত্রার পরিবর্তন, সামাজিক প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন রোগ, শারীরিক ও মানষিক সমস্যাগূলোর জন্য মূলত এ সমস্যার জন্য দায়ী।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অনেক সময়ে সমস্যা বা রোগ নির্ণয় যথাযথ ভাবে হয় না। যে কারণে খুব সামান্য কারনে মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের স্বাদ থেকে অনেকে বঞ্চিত হন।বছরের পর বছর সঠিক পদক্ষেপের অভাবে সঠিক সময়ে সন্তানের আগমন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এজন্য আমাদের প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ, জীবন যাত্রার পরিবর্তন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ এবং এ ব্যাপারে সঠিক ও পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা।

এখন আসি মুল বিষয়ে,বন্ধ্যাত্ব সমস্যার অনেক সহজ সমাধানে আই ভি এফ বা টেস্টটিউব বেবি আজকাল একটি জনপ্রিয় আধুনিক সমাধান এবং ইনফার্টিলিটি সেন্টারগুলোতে প্রধান চিকিৎসার স্থান দখল করে আছে। কিন্তু দিনকে দিন এর নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।এর কারন জানতে হলে আপনাকে জানতে হবে প্রক্রিয়াটিতে মূলত কিভাবে কি করা হচ্ছে। এটা অনেক ভাবেই করা হয় যেখানে ডিম্বানু বা শুক্রানু দম্পতি ব্যতীত তৃতীয় কোন ব্যক্তির থেকেও ক্ষেত্র বিশেষে সংগ্রহ করা হয়।

প্রথমত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরিক্ষা করে রোগ নির্নয় করা হয় এবং প্রাথমিক ভাবে কোন বড় কোন শারীরিক সমস্যা যা থাকলে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে তা অপসারণ করা হয়। এরপর কিছু ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে ডিম্বাশয়ের কার্যক্ষমতা বাড়ানো হয়। এরপর শুক্রানু বিশেষ পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয় এবং   ডিম্বানুও নিয়ে নেয়া হয় স্ত্রী বা মহিলা ডোনার হতে।

এরপর একসাথে রেখে বা আই সি এস আই পদ্ধতিতে ডিম্বানু ফার্টিলাইজ বা নিষিক্ত করা হয়। ফার্টিলাইজেশনের পর এদের কোষ বিভাজন শুরু হয় এবং তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।এবং ব্লাষ্টোসিষ্ট  ধাপে কালচার ও প্রি ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক টেস্টিং করে ভাল মানের ভ্রুন সংগ্রহ করা হয় এবং অস্বাভাবিক গুলো বাতিল বা হিমায়িত করে সংরক্ষিত করা হয়।

এরপর জরায়ুতে একটি বা দুটি ভাল ভ্রূন ট্রান্সফার করা হয়। বাকিগুলো হিমায়িত  করে সংরক্ষন করে রাখা হয়। এখন সমস্যা হচ্ছে এভাবে হিমায়িত করে ভ্রুন সংরক্ষন করে রাখা কতটা নৈতিক বা মানবতা সম্মপন্ন তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারন একটি ভবিষ্যত মানব শিশুর ভ্রূন কে বাড়তে না দিয়ে অন্ধকারে রেখে দেয়া কখনোই মানবিক হতে পাত্র না।

এখন যদি আপনি সংরক্ষন নাও করেন অন্য কাউকে দিয়ে দেন, তাতেও সমস্যা ঘটে যেহেতু এখানে এক দম্পত্তির সন্তান অন্য কারো কাছে চলে গেল, যা তার পরবর্তী জিবনে শিশুর পরিচয়ে ও জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে যা কিনা ও ধরনের টেস্টটিউব শিশুর জীবনীতে পাওয়া গেছে। এখন ধরেন আপনি ভ্রূন রিসার্ভ করতে দিলেন না, আপনি সবি ট্রান্সফার করে ফেললেন, তাও সম্ভব নয় কারন সাধারন্ত ৮~ ১০ টা ডিম্বানু নেয়া হয় এবং ৬-৮ টা ভ্রুন পাওয়া যায় যা কিনা আপনাকে কোন চিকিৎসক  একসাথে রোগীর জীবনের ঝুকি এড়াতে স্বার্থের ক্ষাতিরে ট্রান্সফার করতে দেবেন না কিন্তু যদি দু একটি ভ্রূণ বাছাই করে ট্রান্সফার করা হয় তাহলেও যে শেষ পর্যন্ত সফল ভাবে সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হিবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই, কেননা সাফল্যের হার সেক্ষেত্রে কমে যায়, কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মা ৩৫ -৪০ এর কোঠায় থাকে যার কারণে নিশ্চয়তা কমে যায়, গবেষনায় বলছে যত বেশী ভ্রূন ট্রান্সফার করা হয় । সফলতার সম্ভাবনাও তত বাড়ে এবং  ডিম্বানু নিষিক্তের ৩য় দিনেই জরায়ুতে ট্রান্সফার সাফল্যের হার বাড়িয়ে দেয়। আর জেনেটিক স্ক্রিনিং এ যে বায়োপ্সি এবং হিমায়িত করা হয়(রিপোর্ট আসতে ১০ – ১২ দিন লাগে) এতে ভ্রুনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে. যাই হোক গুরূত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যে দম্পত্তি একটা সন্তানের জন্য হাহাকার করে এই প্রক্রিয়াতে এসেছে তাদের দ্বারাই যদি নিজেদের দুটি, চারটি ভ্রুন কে ফেলে দিয়ে একটি দুটি কে দুনিয়াতে নিয়ে আসেন তা কখনোই নৈতিক হতে পারে না এবং এর নৈতিকতা নিয়ে সারাবিশ্বে এখন প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সে জন্য ধর্মীয় ও মানবতার দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করা উচিত।

এখন আসুন জেনে নেই আমাদের ইসলাম ধর্মে আলেমরা কি বলছেন।

*যে ৫ টি প্রক্রিয়া রয়েছে,  এর মধ্যে ৩ টি তেই স্বামী স্ত্রী ব্যতীত ৩য় ব্যক্তির (স্পার্ম দাতা বা ডিম্বাশয় দাতা বা গর্ভাশয় ব্যবহার করা) সংশ্লিষ্টতা কে হারাম বলেছে ইসলাম যা কিনা বাইরেরদেশ গুলোতে অহরহ হচ্ছে। শুধু মাত্র স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যেই প্রক্রিয়াটি হবে এবং একজন বিশ্বস্ত চিকিৎসক লাগবেন এবং একজন মহিলা বিশেষজ্ঞ *চিকিৎসক মহিলা রোগীর চিকিৎসার  ধাপ গুলো এবং পুরূষ টেকনিশিয়ান বা চিকিৎসক পুরুষের শুক্রানু সংগ্রহতে সহায়তা করবেন এবং তাও বৈধভাবে স্ত্রীর সংশ্লিষ্টতাতে নিতে বলা হয়েছে( সাধারণত হস্তমৈথুন বা Masturbation প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়)।

*চিকিৎসকরা ইসলামিক জ্ঞান সম্পন্ন ও বিশ্বস্ত হতে হবে যার উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখা যাবে। কেননা অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের ডিম্বাশয় বা শুক্রানু ব্যবহারের অভিযোগ থাকে।

  • জেনেটিক স্টাডির জন্য কালক্ষেপন বা হিমায়ীত না করে ভ্রুন দ্রুত জরায়ুতে ট্রান্সফার করতে হবে, আপনি কোনোকিছুই রিসার্ভ করতে পারবেন না, না কোন ভ্রুন বা স্পার্ম বা ওভাম৷
  • এবং অনেকদিন সঠিকভাবে চেষ্টা ও চিকিৎসার পর যদি রোগীর  বা পরিবারের মানষিক( আত্নহত্যা প্রবনতা) বা ঈমানীয় দুর্বলতা পয়দা হয়ে যায় সে ক্ষেত্রেই শুধু এ ধাপে যেতে অনুমতি আছে.

রেফারেন্স নেয়া হয়েছে দারুল ইফতা দেওবন্দ ইন্ডিয়া, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ইসলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অস্বীকার করে না কিন্তু যে সকল প্রক্রিয়া বা ধাপ ইসলামের বিপরীতে যায় তাতে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে।আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যারা ইনফার্টিলিটি চিকিৎসা করছেন তাদের জন্য অনুরোধ, অনেক সময়  ভাল জায়গায় ভাল রেডিয়লজিস্ট এর অভাবে দিনের পর দিন বড় কোন রোগ অনির্ণীতই রয়ে যায় এবং অই অবস্থায় যখন আপনাদের ইনফার্টিলিটি সেন্টারে ভিজিট করে আপনারাও তাদের সে দিক গুলো বিবেচনা করে আগেই আই ভি এফ এর প্রস্তাব না দেয়ার অনুরোধ রইল, কেননা আপনাদের থেকেই ফেরত আসা বা আপনাদের কাছেই সময় চাওয়া রোগীদেরি অনেক সময় স্বাভাবিক ভাবেই সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকেই দির্ঘদিন পরেও মা বাবা হচ্ছেন।

তাই আই ভি এফ এর মত জটিল এবং অত্যন্ত কঠিন প্রযুক্তি যে আপনারা দিনের পর দিন সনেক সময় সফলভাবে সম্মপন্ন করছেন, আপনাদের দ্বারা সঠিক হিস্ট্রি ও রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে অনেক রোগী এই পদ্ধতি ছাড়াই সহযে সুফলতা পেতে পারেন।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সঠিক  সিদ্ধান্ত নেয়ার তৌফীক দিক। আমিন।

ওয়াসালামু আলাইকা ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
ডাঃ এম্ব্রায়ো নাইন,
গবেষক ও লেখক,
ডক্টরিং হেলথ কেয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *